নিজস্ব প্রতিবেদক

২৭ জুন, ২০২৪ ২৩:৪০

বন্যার বড় ধাক্কা পর্যটনে

ঈদের ছুটিতে প্রতিবছর পর্যটকদের ঢল নামে সিলেটে। পর্যটকদের পদভারে মুখরিত থাকে সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলো। আর হোটেল-মোটলগুলোতে কক্ষ ফাঁকা পাওয়া যায় না। আগাম সব বুকিং হয়ে যায়। তবে এবার চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। এবার ঈদের দিন ভোর থেকে তীব্র বন্যা দেখা দেয় সিলেটে। ঝুঁকি বিবেচনায় ওইদিনই সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রশাসন।

পর্যটক না আসায় সিলেটের হোটেল-মোটেল-রিসোর্টগুলোও ফাঁকা পড়ে আছে। ঈদের মতো একটি বড় উপলক্ষ্যেও পর্যটকরা না আসায় বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তরা। সবমিলিয়ে বড় ধাক্কা এসে লেগেছে সিলেটের পর্যটনখাতে।

ক্ষতি বিবেচনায় রোববার থেকে  কিছু পর্যটন কেন্দ্র খুলে দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত তেমন পর্যটক আসেননি সিলেটে। বন্যায় সিলেটে পর্যটন খাতের ক্ষতি চারশ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে জানিয়েছে সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ।

পর্যটক না আসায় বড় ক্ষতির কথা জানিয়ে নগরের জিন্দাবাজার এলাকার হোটেল সিটির মহাব্যবস্থাপক মৃদুল দত্ত মিষ্টু বলেন, প্রতিবার ঈদের সময়ই আমাদের বাড়তি প্রস্তুতি থাকে। নতুন করে এসময় বিনিয়োগও করা হয়। ঈদের ছুটিতে প্রতিবারই ভালো ব্যবসা হয়। কিন্তু এবার খুবই খারাপ অবস্থা। ঈদের পর থেকে পুরো হোটেল প্রায় ফাঁকা। কোনো অতিথি নেই। অথচ অন্যান্যবার ঈদের সময় অতিথিদের জায়গা দিতে হিমশিম খেতে হয়।

সিলেটের অন্যতম পর্যটক আকর্ষনীয় এলাকা গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং। সবসময়ই এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। আর ঈদের সময়ে তো পা ফেলবারও জায়গা পাওয়া যায় না। তবে এবার ঈদের দিন থেকে এই পর্যটনকেন্দ্রও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। রোববার থেকে এটি পুণরায় চালুর ঘোষণা দেয় উপজেলা প্রশাসন। তবে সোমবার জালফং গিয়ে দেখা যায় প্রায় ফাঁকা পুরো পর্যটন এলাকা। নেই কোন পর্যটক।

জাফলং এলাকার গুচ্ছগ্রাম দিয়ে এখানকার মূল পর্যটন কেন্দ্রে প্রবেশ করেন পর্যটকরা। পর্যটকদের উপর ভিত্তি করেই এই এলাকায় গড়ে উঠেছে শতাধিক স্থায়ী ও অস্থায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

সোমবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দুয়েকটি ছাড়া সবগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই বন্ধ। যেগুলো খোলা আছে সেগুলোতেও ক্রেতা নেই।

জাফলংয়ে ঘুরতে আসা পর্যটকদের ছবি তোলার কাজ করেন আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, এবার ঈদের মৌসুমটা একেবারে মন্দ গেছে। কোন পর্যটক আসছেন না। পর্যটক না আসায় আমরা প্রায় বেকার হয়ে পড়েছি।

এই এলাকার গ্রিন রিসোর্টের সত্ত্বাধিকারী বাবুল আহমদ বলেন, এবার ঈদের পর রিসোর্টে কোন অতিথি আসেননি। করোনার সময় একবার এমন অবস্থা হয়েছিলো। এছাড়া আর কখনোই এমন মন্দায় পড়তে হয়নি।

জাফলং পর্যটনকেন্দ্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. হোসেন মিয়া বলেন, পর্যটকদের ওপর আমাদের ব্যবসা নির্ভর করে। জাফলংয়ে প্রায় ৬০০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। এই ৬০০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক, কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ঢলের পানিতে অনেকের দোকানপাট প্লাবিত হয়েছে। অনেকের মালামাল ভেসে গেছে। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এই ভরা মৌসুমে ব্যবসা করতে না পারায় এই লোনের কিস্তি দিতেও আমরা হিমশিম খাচ্ছি।

কেবল জাফলং নয়, সিলেটের সবগুলো পর্যটনকেন্দ্ররই এখন এই অবস্থা। সাদাপাথর, রাতারগুল, লালাখাল, বিছানাকান্দিসহ কোন পর্যটন কেন্দ্রেই এবার ঈদ মৌসুমে পর্যটকরা আসেননি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্ষা মৌসুমে সিলেটে সবচেয়ে বেশি পর্যটক সমাগম হয়। এখানকার পাহাড়, ঝর্না, হাওর, জলাবরণ, নদী- বর্ষায় সবচেয়ে সুন্দর রূপ ধারণ করে। তাই এসময়ে সিলেট অঞ্চলে পর্যটক সমাগম হয় সবচেয়ে বেশি। এবার ঈদ পড়েছে বর্ষা মৌসুমে। তাই এবার বিপুল পর্যটক সমাগমের আশা করেছিলেন এই খাতের উদ্য্ক্তোরা। তবে বন্যা এসে তাদের সেই আশার গুড়েবালি।

পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার কারণে দুই বছর একেবারে স্থবির ছিল পর্যটন খাত। করোনার দীর্ঘ মন্দা কাটিয়ে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠার মূহূর্তে ২০২২ সালের বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে এই খাত। সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠার আগেই এবার আবার বন্যার ধাক্কা পর্যটন খাতে।

সিলেটের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র বিছানাকান্দি। বর্ষা মৌসুমেই এখানকার নদী-ঝর্ণা-পাহাড় মোহনীয় রূপ নেয়। তবে এবার বর্ষায় পর্যটক নেই বিছানাকান্দিতে।

বিছানাকান্দি পর্যটনকেন্দ্রের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন বলেন, অন্যান্য বছর বর্ষায় এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। এবার একেবারে পর্যটক আসছেন না। পুরো ফাঁকা পর্যটন কেন্দ্র।

তিনি বলেন, বিছানাকন্দি পর্যটন কেন্দ্রে রেস্টুরেস্ট, কসমেটিকসসহ বিভিন্ন পণ্যের অর্ধশতাধিক দোকান রয়েছে। এই ভরা মৌসুমেও এগুলো এখন বন্ধ রয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা বড় অংকের ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

বর্ষায় পর্যটকদের ভিড় বাড়ে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরেও। বর্ষায় হাউসবোট নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে রাতভর ঘুরে বেড়ানো সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।  তবে এবারের বন্যায় সেখানেও কোন পর্যটক নেই।


সিলেট হোটেল মোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, সিলেট জেলায় পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল রয়েছে। যার বেশিরভাগই এখন পুরো ফাঁকা।

এই সমিতির সভাপতি সুমাত নুরী জয়েল বলেন, বন্যার কারণে পুরো বিভাগজুড়েই পর্যটক শূন্যতা ও পর্যটন খাতে মন্দা দেখা দিয়েছে। অনেক বড় বড় হোটেল রিসোর্ট ৬০/৭০ পার্সেন্ট ছাড়ের ঘোষণা দিয়েও অতিথি পাচ্ছে না।
 
সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি তাহমিন আহমদ বলেন, কেবল হোটেল-মোটেল নয়, সিলেটের একজন রিকশা চালক, একজন কাপড় ব্যবসায়ীও পর্যটকের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। শ্রীমঙ্গল, জাফলংসহ কিছু এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য তো পুরোটাই পর্যটকদের উপর নির্ভশীল। তার উপর এখন সিলেটে পর্যটনের ভরা মৌসুম।

তাহমিন বলেন, বন্যায় পুরো বিবাগে পর্যটনখাতের ক্ষতি চারশ’ কোটি টাকার মতো হবে। বন্যা কমে গেলেও সিলেটে এখন পর্যটকদের ফেরানো যাবে না। কারণ বেশিরভাগ রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের মনে বন্যা নিয়ে আতঙ্কও আছে। ফলে এই খাতে ক্ষতি আরও বাড়বে।

প্রসঙ্গত, চলতি মৌসুম টানা দ্বিতীয় দফায় বন্যায় আক্রান্ত সিলেট। পাহাড়ি ঢলে ২২ মে প্রথম দফা বন্যা দেখা দেয়। এই পানি কমার আগেই অতিবৃৃষ্টি ও ঢলে ১৩ জুন থেকে ফের বন্যা পরিস্থিদিতর সৃষ্টি হয়। আর ১৭ জুন ঈদের দিন সকালে তলিয়ে যায় সিলেট নগরসহ জেলার বেশিরভাগ এলণাকা। ওইদিনই সিলেটের প্রায় সব পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত