নিজস্ব প্রতিবেদক

০১ জুলাই, ২০২৪ ১৬:৩০

আজাদের বাসায় হামলার নেপথ্যে ‘চোরাই গরুর টাকার ভাগবাটোয়ারা’!

সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদের বাসায় হামলার ঘটনা নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সিলেটের রাজনীতি। বিশেষত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে এ নিয়ে চলছে তোলপাড়।

গত বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে নগরীর ভাটাটিকর ও পূর্ব শাপলাবাগ এলাকায় সিসিক কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদের দুটি বাসায় হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা আখ্যা দিয়ে এর প্রতিবাদে মাঠে নেমেছেন সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর-কর্মকর্তারাও। সোমবারও টিলাগড়ে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেছেন তারা।

তবে একটি জাতীয় গণমাধ্যমের সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় চোরাই গরুর ভাগবাটোয়ারা নিয়েই এ হামলার ঘটনা টেনা ঘটে। হামলার পরপর ফাঁস হওয়া এক অডিও রেকর্ডের সূত্র ধরে সোমবার এমন খবর প্রকাশ করে ওই গণমাধ্যম।  

এতে বলা হয়, ভারত থেকে আসা চোরাই গরু বিক্রির ‘লাভের টাকার ভাগবাটোয়ারা’ নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণেই এ হামলা হয়েছে। এমনকি টাকার ভাগ পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে ওই এলাকার বাসিন্দা একজন সংসদ সদস্যসহ এক প্রতিমন্ত্রীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে।

আজাদুর রহমান আজাদ সিসিকের টানা পাঁচবারের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আজাদের বাসা শাপলাবাগ আবাসিক এলাকায়। এই এলাকায়ই প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী এবং সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরীর বাসভবন। এর পাশ্ববর্তী গোপালটিলায় সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রনজিত চন্দ্র সরকারের বাসা।

গত বৃহস্পতিবার রাতে আজাদের হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার জের ধরে ওই এলাকায় আরও কয়েক নেতার বাড়িতে হামলা হয়েছে। থানায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ জমা পড়েছে।

ফাঁস হওয়া ১ মিনিট ১৬ সেকেন্ডর অডিওতে এসব হামলার কারণ জানা দুই প্রত্যক্ষদর্শীর চাপা উত্তেজনার আলাপে রয়েছে ‘বাজারের’ (টিলাগড়ে কোরবানির পশুর অস্থায়ী হাট) ‘লাভের টাকা’ ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব।

জানা যায়, মূলত ভারত থেকে চোরাই পথে আনা গরু হাটে বিক্রি করা হতো। ওই চোরাই গরুর জন্য বিভিন্ন পক্ষকে টাকা দেওয়া লাগত। কথোপকথনে টাকার অঙ্ক উল্লেখ করে বলা হচ্ছিল, ‘৫০ লাখ টাকা লাভ অইছে!’ আর লাভের টাকা ভাগাভাগি প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘২৫ লাখ, ২৫ লাখ, ৫০ হাজার’। বণ্টনে টাকার অঙ্কের এমন বৈষম্যে বাসায় হামলা, পাল্টা হামলা প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘মাইর লাগবনানি!’

কী আছে ফাঁস হওয়া অডিওতে
(কথোপকথন শুনে ধারণা করা হচ্ছে, তারা এক আড্ডায় বসে ঘটনার নেপথ্য কারণ নিয়ে কথা বলছিলেন। দুজনের মধ্যে একজনকেই বেশি কথা বলতে শোনা গেছে। তাদের কথাবার্তা টাকা ভাগবাটোয়ারা প্রত্যক্ষ করার মতো। নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে কথোপকথনকারী দুজনের নাম প্রকাশ করা হয়নি।)

প্রথমজন: তারার তারার বাজার করছে, তারা নিচে এর লাগি কিতা হইছে। আজাদ ভাইর (ওয়ার্ড কাউন্সিলর আজাদুর রহমান) কথা হইল আমি এখলা খাইলাইতাম। ওই যে ...র লাখান। ... যে সময় টেকা শুরু করে যে সময় ফাইলায়নানি, ইসময় কয় ... কত দিছিল? এখন হই গেছে টেকা আমার কাছে। ... আজাদে কম নিলেও লইছইন ওলা। অখন ছফু ভাইর (ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য) বাসা কিলা কিতা করে ভাইঙা ডুইঙা। এখন তো ছফু ভাইয়েও মামলা আরেকটা করব।

দ্বিতীয়জন: তারা ৫০ হাজার দিছে, হইছে না ইখটায়।

প্রথমজন: তারা পাইছে ২৫ লাখ। ২৫ লাখ টাকার মাঝে তারারে দিছে ৫০ হাজার। আজাদ ভাইয়ে ২৫ লাখ। ৫০ লাখ টাকা বাজারও লাভ হইছে। রনজিত দায় (সংসদ সদস্য রনজিত সরকার) নিছইন ২৫ লাখ। আজাদ ভাইয়েও ২৫ লাখ নানি। তারারে মিনিমাম ১০-১৫ লাখ দিত। তারা দিছে না। তারা মন্ত্রী গ্রুপ, তুমি দিতায়নানি। তাইন দিরা ইনো ৫০ হাজার। মাইর লাগবোনি না লাগত না, আফনে আমারে কইন। এর মাঝে তারা তিন দিন ধরি খালি বিচার বওয়াইছে। শেষ করিলাইন, শেষ করিলাইন, শেষ করিলাইন না। হিতায় কইছে তে আর মাইর কর। তে তুমি মাইর কইছতে মাইনষে কিতা বই থাকবনি। মাইনষের ইজ্জতের বিষয়। ইতায় কইছইন অখন মরলে মরি যাইমু, সমস্যা নাই। মন্ত্রী বাঁচাইলে বাঁচাওকা, না বাঁচাইলে নাই। মন্ত্রী কইছইন তোমরা আর মাইরটাইর লাগাইও না। আমি ... তো ক্লিন ইমেজ। কিন্তু ক্লিন ইমেজ হইয়া অখন যাওয়াটা আমার সমীচীন নয়। আমি যাব, মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব, কালকে আমি একটা জায়গায় গিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব...।

কথোপকথনে নাম আসা ছফু আহমদের বাসায় হামলা হয়েছে কাউন্সিলর আজাদের বাসায় হামলার পরদিন শুক্রবার দুপুরে। তবে ছফু আহমদ কথোপকথনে তার নামটি কে বা কারা, কেন বলেছে, এসব সম্পর্কে অবহিত নন বলে দাবি করেন।

 ছফু আহমদ বলেন, ‘আজাদ ভাইয়ের বাসায় হামলার নিন্দা জানাই। কিন্তু এর জের ধরে আমার বাসায় হামলার বিষয়টি নানা কথার জন্ম দিচ্ছে।’ তিনি জানান, তার বাসায় হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় তিনি থানায় অভিযোগ দেবেন।

এদিকে, ওয়ার্ড কাউন্সিলর আজাদ কথোপকথনের বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে তার বাসায় হামলার জন্য তিনি চিনি চোরাকারবারিদের দায়ী করেন।

আজাদ বলেন, ‘এই টিলাগড় দিয়ে সীমান্ত থেকে আনা চোরাই পণ্যসহ চিনি পরিবহন হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি বাধা দিয়েছি। এর জের ধরে হামলা হয়েছে।’

এ বিষয়ে সংসদ সদস্য (সুনামগঞ্জ-১ আসন) রনজিত সরকার বলেন, সিলেট আওয়ামী লীগে কোন গ্রুপিং নেই, টিলাগড়েও নেই।

কাউন্সিলর আজাদের সঙ্গে তার অনুসারীদের দ্বন্দ্বের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এসব এখন নেই। আজাদ আমার পুরোনো বন্ধু। অনেক পুরোনো সম্পর্ক। আর আমিও সংসদ সদস্য হওয়ায় এখন এখানকার (টিলাগড়) একজন অতিথি মাত্র। সংসদীয় আসন ও জাতীয় সংসদ ভবন ছাড়া তো যাতায়াত নেই। তার বাসায় হামলা হয়েছে শুনে আমি সব কাজ ফেলে ঢাকা থেকে প্লেনে ছুটে এসেছি। আজাদের বাসায় গিয়েছি। এ রকম হামলার ঘটনা প্রশ্রয় দেওয়ার মতো নয়।’

কারা হামলা করেছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো দিনের মতো স্পষ্ট। এখানে ছিনতাইকারী, চোরাকারবারি, হেরোইন কারবারিকে রাজনৈতিক প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। বংশগতভাবে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটছে। এখনকার ঘটনা নিয়ে দুই-তিন দশক আগের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দেখুন। ক্রসফায়ারে কারা মরেছে দেখুন। এরপর প্রশ্ন করুন।’

কথোপকথনে তার নামে ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর আজাদের নামে ২৫ লাখ করে ৫০ লাখ টাকা ও কথিত মন্ত্রী গ্রুপে ৫০ হাজার টাকার ভাগবাটোয়ারা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য রনজিত বলেন, ‘আমি কী আগের রনজিত নাকি! আর আপনারা কী আমাকে আগের মতো করে দেখছেন? আমি কিন্তু টাকা খরচ করে এমপি হইনি। রাজনীতি করে এমপি হয়েছি। টাকার পেছনে কখনো ছুটিনি। কেউ বলল, আর আপনার লুফে নিলেন, এটা হয় না। আমি টাকা রোজগার করলে রাজনীতি করতাম না, এমপি হতাম না। রাজনীতি করছি মানুষের জন্য। টাকার জন্য না।’

থানায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের শাহ পরাণ থানায় হামলার ঘটনায় দুটি পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন থানার ওসি হারুনুর রশিদ চৌধুরী। তিনি জানান, এই ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের সবাইকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

পাল্টাপাল্টি দুটি অভিযোগের একটি থানায় দাখিল করেছেন কাউন্সিলর আজাদ। এতে হামলাকারী ১৪ জনের নাম উল্লেখ করা। অভিযোগে বলা হয়, হামলাকারীরা এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, মাদক কারবারি, ত্রাস সৃষ্টিকারী ও জবর দখলকারী। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অপকর্ম করায় স্থানীয়রা আমার কাছে বিচার চাইলে আমি তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিই। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে হত্যার পরিকল্পনা করে বাসায় হামলা করে।

এদিকে বাসায় হামলা, চাঁদাবাজি, প্রাণনাশের হুমকি, লুটপাটের ঘটনায় থানায় পাল্টা অভিযোগ দিয়েছেন সিলেট মহানগর যুবলীগের সদস্য শমসের আলী। ওয়ার্ড কাউন্সিলর আজাদসহ ১৮ জনের নামোল্লেখ করে অভিযোগ করা হয়েছে। এতে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজির অভিযোগও করা হয়।

সূত্র: খবরের কাগজ

আপনার মন্তব্য

আলোচিত